আমার স্বামী রাশেদ আজ আমাদের একমাত্র মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে চরম অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছে। আমার উচিত ছিল তীব্র কষ্টবোধ করা অথচ আমি তাঁর জন্য তেমন কষ্টবোধ করছি না। ঘটনা বলতে গিয়ে সে যখন ফুপিয়ে কেঁদে উঠল আমি তাকে সান্ত্বনা পর্যন্ত দিলাম না। বরং আগ্রহ নিয়ে তার শোকার্ত চেহারা দেখতে লাগলাম।bangla story,
এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল !! আমি জানতাম কোন একদিন এমন কিছু ঘটবে। কোন একদিন সে এভাবে অপমানিত হয়ে ঘরে ফিরবে এই দৃশ্য কল্পনায় আমি বহুবার দেখেছি।bangla story, valobasar bangla golpo,
রাতে রাশেদ ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়ল। আমি তাকে বিরক্ত না করে নিঃশব্দে এক কাপ চা হাতে বারান্দায় এসে দাড়ালাম।
আকাশে আজ বিশাল চাঁদ । সেই চাঁদের আলোতে অপূর্ব ঝলমলে একটি শহর...!! সেই শহর দেখতে দেখতে আমার চোখ ভিঁজে উঠল। bangla story
আমি মিতু। আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে প্রথম এই ঢাকা শহরে পা রেখেছিলাম, রাশেদের স্ত্রী হয়ে আমার শ্বশুর বাড়িতে। আমার বয়স তখন উনিশ। আমার জন্ম একটি মফস্বল শহরে, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে।
বিয়ের পর যেদিন প্রথম রাশেদদের এই ঢাকার বাড়িতে আসি তাদের এই একতলা বিশাল বাড়িটিকে আমার কাছে রাজপ্রাসাদ বলে মনে হয়েছিল। আর আমি এতো বড় বাড়ির একমাত্র পুত্রবধূ...এই ভেবে মনে মনে ভীষণ গর্বিত, আনন্দিত হয়েছিলাম।
তবে আমার সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না । বিয়ের কিছুদিন পরই আমি বুঝে গেলাম আমার মতো মফস্বলের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে পুত্রবধু করলেও আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতে তারা খুব একটা আগ্রহী নয়।
আমাদের বিয়ের এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু কেউ আমার বাবার বাড়ির কাউকে এ বাড়িতে আসতে আমন্ত্রণ জানালো না। দীর্ঘদিন তাদের না দেখতে পেয়ে আমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগলাম।
আমার শ্বাশুড়ি ছিলেন সংসারের মধ্যমনি, কর্ত্রী আর রাশেদ তার মায়ের কথার বাইরে কিছুই করত না। শেষে এক সন্ধ্যায় আমি তার কাছেই ভয়ে ভয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা তুললাম।
--- মা, কিছুদিনের জন্য বাবার বাসায় যেতে চাই। কখনো তাদের ছেড়ে থাকিনি,.... খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, bangla story
-- এতো বাবার বাড়ি, বাবার বাড়ি করলে তো সংসার হবে না বৌমা। রাশেদ এখন কোথাও যেতে পারবে না। তোমার শ্বশুরের মৃত্যুর পর সমস্ত ব্যবসা দেখাশোনা রাশেদকেই করতে হয়। তাছাড়া, আমার নিজের শরীরটাও ভাল নেই।
তারপরও তুমি যেতে চাইলে একা যাও। তোমার বাবাকে বলো এসে নিয়ে যাক। bangla story
অভিমানে সেবার আমার আর যেতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু বাবাকে বললাম আমাকে যেন দেখে যান ।
এক সকালে বাবা আমার ছোট বোনটিকে নিয়ে আমাকে দেখতে এলেন। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তাদের প্রতি এ বাড়ির লোকদের অবহেলা, উদাসীনতা ।.. নতুন অতিথিদের খাতির যত্ন বা আপ্যায়নের জন্য এ বাড়ির কেউ সামান্যতম ব্যস্তও হলেন না।
...আমরা রাশেদদের মতো ধনী ছিলাম না। কিন্তু আমার বাবা - মা অতিথি পরায়ণ ছিলেন। বাসায় কোন নতুন অতিথি এলে আমার মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পরতেন তাদের আপ্যায়ন করতে। দরিদ্র আত্মীয় হলেও কখনো কাউকে অসম্মান বা অনাদর করতে দেখিনি ।
আমার সহজ সরল বাবা সেদিন দীর্ঘক্ষন বাইরের ঘরে বসে থাকার পর আমার শ্বাশুড়ি দেখা করতে গেলেন অল্প সময়ের জন্য। রাশেদ ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলল তারও কম সময় .... । চা, বিস্কুট আর কলা দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করা হলো। দুপুরে খেয়ে যাবার কথা একবারও বলা হলো না।
বাবা সেদিন এসেছিলেন সাধারন পোশাকে। আসলে দামি শার্ট বা কাপড়চোপড় পরবার ইচ্ছা বা অভ্যাস কোনটাই তার ছিল না। তাই দেখে শাশুড়ী মা তাচ্ছিল্যের সুরে আমাকে আড়াঁলে ডেকে নিয়ে বললেন,
--- তোমার বাবাকে বলবে এরপর ঢাকা এলে যেন ভাল কাপড় পরে আসে। আমাদের একটা মান - সম্মান আছে।
ছোটবেলায় পড়া শেখ সাদীর গল্পের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল ঐদিন আমার । কি অদ্ভুত এরা.., পোশাকের দাম দেখে এরা মানুষকে বিচার করে...।। bangla story
সেদিন ভর দুপুরে বাবা ক্লান্ত শরীরে ছোট বোনটির হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর ঘৃণা, অপমানে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। bangla story
....সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অনেক কিছু সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছেন কিন্তু পিতা - মাতার অপমান সহ্য করার ক্ষমতা দেননি,..... এই কঠিন সত্য সেইদিনই প্রথম আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।
আমি মনে -প্রাণে চাইতাম আমার বাবার বাড়ির কেউ যেন এই বাড়িতে না আসে। বাবাকে অপমানিত হতে দেখা আমার জন্য ভয়াবহ কষ্টের ছিল । তাই আমি আর কোনদিন তাকে এ বাড়িতে আসতে বলিনি। নিজেও বাবার বাড়িতে যেতাম খুব কম।
তবুও বাবা আসতেন। অনেকদিন আমাকে দেখতে না পেলে তিনি ছুটে আসতেন।.... যতদিন বেঁচে ছিলেন সারারাত জার্নি করে ক্লান্ত শরীরে আমাকে দেখতে আসতেন।
প্রতিবার প্রায় একই ঘটনা ঘটত ।
প্রতিবারই তাদের অবহেলা পেয়ে অপমানিত বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে আস্তে আস্তে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন । আর তা দেখে প্রতিবার স্বামী, শ্বশুর বাড়ির প্রতিটি লোকের প্রতি আমার মনে অভিমান, ক্ষোভ আর ঘৃণার পাহাড় জমত।
--- মিতু, মিতু একটু এদিকে এসো তো।
ঘরে ঢুকে দেখি রাশেদ তখনও জেগে আছে।
-- এখনো ঘুমাওনি?
-- ঘুম আসছে না।
-- কিছু খাবে?
- না, তুমি আমার পাশে বস। bangla story
আমি রাশেদের মাথায় হাত রাখলাম।
.. এই মানুষটিকে আমি ভালবাসতে চেয়েছিলাম। মন - প্রান উজার করে তীব্রভাবে আমি তাকে ভালবাসতে চেয়েছি।
কিন্তু, যতবার তার কাছে গিয়েছি ততবার বাবার করুন মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আমার অসহায় মা, ভাই, বোনের কথা মনে পড়েছে, বাবার মৃত্যুর পর যাদের দুঃ সময়ে আমি পাশে দাঁড়াতে পারিনি।
.. আমি থমকে গেছি।
অথচ... আমি জানি, আমার ভালবাসবার ক্ষমতা প্রচন্ড ।।
আমার শ্বাশুড়ি মা তার জীবনের শেষের দিকে ক'টা মাস যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন, আমি তার সেবা করেছিলাম । তবে আরও আন্তরিকভাবে তার সেবা- যত্ন আমি করতে পারতাম, কিন্তু মন থেকে আসেনি। আমি যা করেছিলাম তা কেবলই দায়িত্ব পালন। bangla story
তবে, আমি সত্যিই কখনো কাউকে ঘৃণা করতে চাইনি। আমি মনে মনে অসংখ্যবার চেয়েছি তারা তাদের ভুল বুঝুক। তারা একবার নিজের ভুল স্বীকার করুক। আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম তাদের পরিবর্তন দেখতে। কিন্তু বাস্তব জীবন, নাটক -সিনেমার মতো নয় বলেই হয়তো শেষ দৃশ্যে এখানে সবাই তাদের নিজেদের ভুল বুঝতে পারে না।
ভোরের দিকে রাশেদ ঘুমিয়ে গেল। আমি জেগে রইলাম।
আমাদের একুঁশ বছরের মেয়ে নিতুকে তার পছন্দের ছেলের সাথে আমরা পারিবারিকভাবেই বিয়ে দিয়েছি মাত্র মাসখানেক আগে। মেয়ের শ্বশুর এলাকার নামী লোক, প্রভাবশালী ব্যক্তি। তবে কোন এক অজানা কারণে তিনি রাশেদকে অপছন্দ করেন দেখেছি। আজ মেয়েকে দেখতে গিয়ে সেই বাড়ি থেকে রাশেদ চরমভাবে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছে। অথচ রাশেদের জন্য আমি তেমন দু:খবোধ করছি না।
কেবলই মনে হচ্ছে, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল।
খুব ভোরে ডোর বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখি নিতু দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দুটো লাল। চোখের নীচে কালি।
আমাকে দেখে সে মুঁচকি হাসল।
মা, চলে আসলাম। আর যাব না ঐ বাড়িতে ।
আমার জীবনে স্বপ্নে এমন দৃশ্য আমি অসংখ্যবার দেখেছি...।
আমি প্রায়ই ভাবতাম বাড়িতে গিয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরে বলব, "চলে এলাম মা। অসম্মানের রাজপ্রাসাদে আমি থাকতে চাই না। "
বলা হয়নি।।
আমি ভীতু ছিলাম। আমার বাবা - মা'ও সাহসী ছিলেন না।
আমার মেয়ে আমার মতো নয়।
বাবা কোথায় মা?? তোমরা আবার আমাকে ফিরে যেতে বলবে না তো!! তাহলে কিন্তু খুব খারাপ কিছু হবে।
নিতু খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে অথচ আজ কেমন জেদি ভঙ্গিতে কথা বলছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি।
সে উত্তরের অপেক্ষায় আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
না, আমি আমার মেয়েকে ফিরে যেতে বলব না। মন উজার করে ভালবাসতে না পারার হাহাকার আমি জানি। এক বুক ঘৃণা নিয়ে জীবন কাঁটিয়ে দেয়ার কষ্টও আমার অজানা নয়। আমার মেয়েকে সেই একই পথে হাঁটতে আমি বাধ্য করতে পারি না।
মেয়েটা শান্ত ভংগীতে তার বাবার রুমের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানি কি প্রচন্ড ঝড় তার মনের ভেতরে চলছে। নিতু ভীষণ নরম মনের মেয়ে হলেও ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ তার।
সে শোবার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। মনে হলো কিছু একটা ভাবছে।
সে আমাদের একমাত্র মেয়ে হলেও আমি তাকে অতিরিক্ত আদরে বড় করিনি। বরং শাসনটাই করা হয়েছে বেশি। তবে রাশেদ তাকে সেভাবে কখনো শাসন করেনি। ছোটবেলায় নিতু তার বাবার আদর, ভালবাসা পেতে নানা রকম পাগলামি করত। তাদের বাবা- মেয়ের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো।
নিতু আস্তে আস্তে তার বাবার রুমের দিকে এগুচ্ছে..
হে পরম করুনাময়, নিশ্চয়ই পৃথিবীর সব মানুষ অমানুষ নয়. মানুষও আছে। মেয়েটার জীবন আপনি তেমন সত্যিকারের মানুষের ভালবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিন।।
ভালবাসাহীন জীবন বড় কষ্টের ।। bangla story, valobasar bangla golpo,
জীবনে অর্থ -বিত্ত কম হলে হোক তবু মায়া, ভালবাসার কমতি যেন তার জীবনে কোনদিন না হয়....।।
দূর থেকে আমি তাদের বাবা - মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সেই শব্দে আমার ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে ।
বুকের ভেতরে জমে থাকা এতোদিনের ঘৃণার পাহাড় ধীরে ধীরে কি গলে যাচ্ছে আজ ??!
তবে আমি জানি.. ঠিক এভাবে আমি প্রতিশোধ নিতে চাইনি।। bangla story, valobasar bangla golpo,
লেখা- ফয়ছল আহমেদ রাফি