শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০২০

ধর্ষণ এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া - Bangla Story

'আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাদের পায়ে ধরি, আমাকে মাফ করেন। যেতে দিন দয়া করে।'সায়মার কান্না জড়ানো কথাগুলো হায়েনাদের অট্টহাসির নিচে চাপা পড়ে যায়। সায়মার কান্নায় যেন তারা আরও বেশি আনন্দে উল্লাসে ফেটে ওঠে।bangla story, valobasar bangla golpo,

দুপুর বারোটা নাগাদ টিউশন শেষে বাড়ি ফিরছিলো সায়মা। কয়দিন বাদেই ছাত্রের পরিক্ষা। তাই শুক্রবারও পড়াতে আসতে হচ্ছে তাকে। আগে এই টিউশনটা সন্ধ্যের পরেই পড়াতো সে। কিন্তু দিনকালের অবস্থা খারাপ বলে, সন্ধ্যার আগেই সব টিউশনগুলো শেষ করতে হয় এখন তাকে।bangla story, valobasar bangla golpo, বাংলা ভালবাসার গল্প

সায়মার মুঠোফোনে রিংটোনের শব্দ হচ্ছে। হায়নাদের একজন ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফোনটা আবার ফ্লোরে ফেলে রাখলো।
সায়মা আকুতি ভরা স্বরে বললো, 'ফোনটা আমার কাছে দিন দয়া করে। নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে কল করছে। ফোন রিসিভ না করলে মায়ের প্রেশার বেড়ে যাবে। দয়া করে ফোনটা দিন।'
সায়মার আকুতি শুনে সবার হাসির মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেলো।
'তোর মাকেও ডেকে এখানে নিয়ে আসি! একসঙ্গে দুইজন। বেশ ভালো জমবে কী বলিস?'
মানুষরূপী এক পশুর মুখে এমন কথা শোনা মাত্রই ক্রোধে তার মুখের উপর এক দলা থুতু ফেললো সায়মা। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো নরপশুর দল।
সায়মাকে একজন শক্ত করে চেপে ধরে বললো, 'এতো তেজ ক্যান তোর? সব তেজ আজ মাটিতে মিশিয়ে দিব। দেখি তুই কী করিস!'
অসহায় সায়মার চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। ভয়ে নিজের মধ্যে নিজেই প্রতিনিয়ত কুঁকড়ে যেতে থাকলো। আশেপাশে কেউ নেই তাকে রক্ষা করার। জায়গাটা বেশ নিশ্চুপ। লোকজন কিংবা গাড়ি-ঘোড়ার তেমন একটা চলাচলও নেই আশপাশ দিয়ে। যেন স্থানটা বখাটেদের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছে এলাকাবাসী। বখাটে মাস্তানরা এখানে নেশা করতে আসে দল বেঁধে। কাজ শেষ হলে চলে যায় আর ফেলে যায় কাঁচের ছোট বড় বোতল, সিগারেটের টুকরো, গাঁজার প্যাকেট ইত্যাদি। ভদ্রলোক তো দূরের, এই সীমানায় ভুল করে কখনো একটা কুকুর বেড়ালও আসে না।
সায়মার মুঠোফোনটায় এখনো রিংটোনের শব্দ হচ্ছে। একটু আগেই তার শরীরের উপর এক দফায় নির্যাতন শেষ হয়েছে। সায়মার কানে রিংটোনের শব্দ পৌঁছালো।
ভাঙ্গা স্বরে সায়মা প্রশ্ন করলো, 'এখনো কী মা কল করছে?'
সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একজন বললো, 'না, এবার তোর বাবা। এই ব্যাটার এত কল করতে হবে কেন! মেয়ে বাড়ি নেই তোরা স্বামী স্ত্রী বাড়ি বসে ফুর্তি কর। তা না কল দিয়ে যাচ্ছে তো দিয়েই যাচ্ছে।'
পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, 'বললাম তো ফোনটা বন্ধ করে দে। এত ফোনকলের শব্দে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।'
'ফোনকলের শব্দ শুনলে আমাদের নায়িকা কেমন ছটফট করে ওঠে দেখিস না। ওটাই তো দেখতে বড্ড মজা।'
'যথেষ্ট হয়েছে। এবার ওটা বন্ধ কর। এই একই শব্দ আর নিতে পারছি না। যে কাজ করতে এসেছি, ওটা শান্তিতে করতে দে।'  bangla story, valobasar bangla golpo, বাংলা ভালবাসার গল্প
পশুগুলোর কথা শুনে সায়মা ডুকরে কেঁদে উঠলো। নিজেকে এখন তার পৃথিবীর সবথেকে নিরুপায় মানুষ মনে হচ্ছে।
কান্না জড়ানো কন্ঠে সায়মা আস্তে বললো, 'বাবা, হার্টের রোগী। ডাক্তার বলেছে, তাকে দুশ্চিন্তায় না রাখতে। আমি কী শুধু একবার কথা বলতে পারি বাবার সঙ্গে? ভয় নেই আমি এখানকার কথা কিচ্ছু বলবো না। শুধুই তাকে চিন্তা করতে বারণ করবো।'
নরপিশাচদের একজন অট্টহাসি দিয়ে বললো, 'আমরা তোমার বাবার হার্ট দিয়ে কী করবো নায়িকা! আমরা তো শুধু তোমার হার্টের পরশ চাই।'
ভেজা চোখ জোড়া আবার ভিজলো সায়মার। ফোনটা বন্ধ করে দিলো পশুরা। আরেক দফায় ঝাপিয়ে পড়লো সায়মার শরীরের উপর। খুবলে খাচ্ছে ওরা শরীরটাকে। সায়মার দীর্ঘশ্বাসে বিষাক্ত হয়ে উঠলো বাতাস।
টিউশন শেষ করে বাড়ির দিকেই রওনা হয়েছিলো সায়মা। শুক্রবার ওই গলিতে গাড়ি পাওয়া খুব দুষ্কর। শুক্রবারে বিকেল অব্দি ওখানকার রাস্তাঘাটে তেমন লোকজনকেও দেখা যায় না। রিকশা না পাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগুচ্ছিলো সে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকটা লোক তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। রাস্তা ফাঁকা থাকায় কারো সাহায্যও পেলো না অসহায় সায়মা। ধস্তাধস্তি করে মুখ, হাত, পা বেঁধে তাকে নিয়ে আসা হলো দেয়ালে ঘেরা এই নীরব স্থানে। বেশ ঝোপঝাড় থাকার কারণে দূর থেকে বোঝার উপায়ও নেই এখানে কেউ আছে। মুখ খুলে দিলে সায়মা চিৎকার চেঁচামেচি চেষ্টা করতেই মারধর শুরু করে জানোয়ারের দলেরা। হাত পা বেঁধেই মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হয় সায়মাকে। চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছিলো তার। জুম্মার আযানের আওয়াজ ভেসে আসছিলো তখন।
সায়মা ভেতরে ভেতরে প্রাণপণে কামনা করে যাচ্ছিলো, কেউ একজন আসুক কিংবা কেউ টের পাক। আর তাকে উদ্ধার করুক এই জাহান্নাম থেকে। কিন্তু কেউ আসে না। চারপাশ জুড়ে নিস্তব্ধ নীরবতারা ঘিরে রেখেছে তাকে।
দুই দফায় পাঁচ জন ধর্ষণ করলে জ্ঞান হারায় সায়মা। অনেকক্ষণ চেষ্টা শেষে চেখে মুখে পানি ছিটিয়ে, পানি খাইয়ে জ্ঞান ফিরলে আরেক দফায় তিনজন ধর্ষণ করে তাকে। দূর্বল সায়মাকে এখন মনে হচ্ছে যেন একটা জীবন্ত লাশ। অতি উন্মাদনায় এক নরপিশাচ সিগারেটের আগুন ঠেসে ধরে সায়মার শরীরের বিভিন্ন স্থানে। যন্ত্রণায় সায়মা ছটফট করে উঠতে থাকে। তার কষ্ট দেখে আরও বেশি আনন্দ পায় সে নরপিশাচ।
খুব দেরিতে হলেও সায়মার আকুতি কবুল হয়। কেউ একজন পাশ থেকে যাওয়ার সময় সায়মার কাতর কন্ঠ শুনতে পায়।
বেশ চেচিয়ে বলে উঠেন, 'কে ওখানে?'
ভদ্রলোক সামনে এগুতে লাগলেন। তাকে দেখা মাত্রই পশুদের দল এক এক করে কেটে পড়লো। ভদ্রলোকের হাক শুনে আরও লোকেরা চলে আসে। এত যন্ত্রণার মাঝেও সায়মার ভেতর আশার আলো জাগে। লোকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। তারপর পুলিশ এতে ভীড় জমায়। খবর পেয়ে ছুটে আসে সায়মার বাবা-মা।
সায়মার বাবা হাউমাউ করে কান্না করে বলেন, 'আমার কী সুন্দর মেয়েটা বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আর এখন কী অবস্থা করে ছেড়েছে ওরা!'
সায়মার ময়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারিপাশ।
'আমার মেয়েটা ওদের কী ক্ষতি করেছিলো? ওরা কেন আমার মেয়েটার এত বড় ক্ষতি করলো? ওর সুন্দর জীবনটায় কেন ওরা দাগ এঁটে দিলো? আমার মেয়েটা বাঁচবে তো এখন?'
নরপিশাচদের শাস্তির দাবিতে রাস্তাঘাটে লোকজন জড়ো হয়ে পড়ে। জনগণের চাপে পড়ে প্রশাসনের লোকেরাও দেশের আনাচে-কানাচে খুঁজে পলাতক সেই অমানুষদের খুঁজে বের করে। সুস্থ হয়ে ওঠে সায়মা। জীবনের সঙ্গে এঁটে দেওয়া সে দাগ মুছে যায় না তবুও।
আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে, উপর মহলের এমন প্রতিশ্রুতিতে রাস্তা ছেড়ে ঘরে ফেরে এলাকাবাসী। এরপর দিনের পর দিন কাটে। শাস্তির রায় হবে হবে করে আর হয়ে ওঠে না।
একদিন আসামীরা মুক্ত বাতাসে সুস্থ নিঃশ্বাস নেয় সুন্দরভাবে। সে বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় সায়মাও। তবে তার জীবনটা আর সুন্দর নেই। শরীরে সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সিগারেটের আগুনের সাহায্যে সেই ক্ষতের চিহ্ন এখনো যে শরীরেই স্পষ্ট জেগে আছে। সেই চিহ্নগুলো এখনো তাকে মনে করিয়ে দেয় বর্বর সেই সময়ের কথা, অমানুষগুলোর কথা। সেই দাগ এখনো তাকে ঘুমাতে দেয় না রাতে, বাঁচতে দেয় না শান্তিতে, মুক্তি দেয় না যন্ত্রণা থেকে, ভুলিয়ে দিয়েছে হাসতে। অথচ অমানুষগুলো মানুষের বেশে হাসিখুশি ভাবে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে।বাংলা গল্প, ভালবাসার গল্প
যে হাওয়া গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ায় অপরাধীরা। সেই হাওয়া সায়মার কানে এসে বাজে যেন বিষের মত।
যেন ফিসফিস করে বলে যায় তাকে, 'তুমি একজন ধর্ষিতা।'
ছোট্ট একটা গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে সায়মা। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হয় না, কারো সঙ্গে কথাও বলে না। হাসি খুশি, চঞ্চল, আসর জমানো মেয়েটা এখন নীরস।
কিছুদিন বাদেই সায়মার এলাকায় ধর্ষিত হয় আরেক মেয়ে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সকলে। এবার সবার চোখে মুখে যেন আগুন জ্বলছে। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া সায়মা বের হয় মিছিলে। দু'চোখ ভর্তি ঘৃণা। তার হাতে একটা প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা, 'ধর্ষকের শাস্তি বলতে আমি কেবল মৃত্যদণ্ড বুঝি।'
উপর মহলের লোকেরা এবার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে বাধ্য হয়। রাজপথের সকলে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সায়মাও।  bangla story, valobasar bangla golpo, বাংলা ভালবাসার গল্প
গলির দোকানে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কেরাম খেলতে থাকা লোকেদের মাঝ থেকে কেউ একজন সায়মাকে ইঙ্গিত করে পাশের লোকেদের প্রশ্ন করে, 'ওই সেই মেয়েটা না?'  bangla story, valobasar bangla golpo, বাংলা ভালবাসার গল্প
পাশ থেকে একজন জবাব দেয়, 'হ্যাঁ, সেই ধর্ষিতা মেয়েটা।'

bangla story dhorshon, valobasar bangla golpo, bangla story, বাংলা গল্প, ভালবাসার গল্প



লেখক- Mahfuja Rahman
Disqus Comments