সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০

আমার প্রিয়তম - Bangla Story

অফিস থেকে এসে শুনলাম আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড বিষ্ময় নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মা এতক্ষণে রান্নাঘরে চলে গেছেন। পাত্রপক্ষ আজই আসবে নাকি। আমিও বিষ্ময় কাটিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। হাজার হোক মায়ের আদেশ বলে কথা। যদি ইসলামের জ্ঞান না থাকতো তাহলে হয়ত উচ্চস্বরে মায়ের সাথে কথা বলে রাগারাগি করে ফেলতাম। যাক, যতটুকু জ্ঞান আছে তাতেই সন্তুষ্ট। Bangla Story

আমার সবসময় স্বপ্ন ছিলো আমার স্বামী লম্বায় ছয় ফুট হবে এবং সুঠাম দেহের নজর কাড়া সুদর্শন যুবক হবে। আমি নিজেও খুব সুন্দরী। যার কারণে আমার এমন চাওয়া। মনে মনে ভাবলাম আজ হয়ত পাত্র তেমনই হবে। কিন্তু আমার আশায় পানি পড়লো। একেতো পাত্র কালো। তার উপর খাটো এবং পেটে ভুড়ি আছে। আমার পছন্দের ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই। মনটা খুব খারাপ হলো। ভাবলাম এখানে বিয়ে হবে না। এক সপ্তাহ পর শুনলাম এখানেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মনটা আবারো বিষন্ন হয়ে উঠলো। তাও রাজি হলাম কারণ আমার নিজের পছন্দ ছিলো না। আর কার ভরসায় এই পাত্রকে তাড়িয়ে দেবো? Bangla Story
Bangla Story, ভালবাসার গল্প, বাংলা গল্প, ভালবাসার বাংলা গল্প,
ছবি-আমার প্রিয়তম - Bangla Story

যথসময়ে বিয়েও সম্পন্ন হলো আমাদের। বর তার নিজের গাড়িতে করে নিয়ে এলো আমাকে তার বাড়িতে। তার ঘরের খাটটা ছিলো পুরানো আমলের। জিনিসপত্র সব পুরানো আমলেরই ছিলো। মনটা আরেকদফা খারাপ হলো। দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে নিলাম। যেহেতু ইসলামে বলা আছে, স্ত্রী যেনো স্বামীর ধন সম্পদ নিয়ে অখুশি না হয় তাই মন খারাপটা আর টিকতে দিলাম না। শুনেছিলাম, ফাতেমা (রাঃ) তাঁর স্বামী আলী (রাঃ) এর কাছে নতুন কাপড় নিয়ে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যান। আলী (রাঃ) কষ্ট পেয়ে সেদিন যুদ্ধের ময়দানে চলে যান। ফাতেমা (রাঃ) স্বমীর পায়ে ধরে মাফ চেয়েছিলেন। সেদিন রাসূল (সাঃ) বললেন, ফাতেমা আলী যদি মনে কষ্ট নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়ে যেতো। কেয়ামতের দিন তোমাকে আমি আমার কন্যা বলে পরিচয় দিতাম না।" এই একটা কথা মনে পরতেই আর অখুশি হলাম না। তাই তাকে সানন্দে স্বামী হিসেবে সর্বস্ব দিয়েই গ্রহণ করে নিলাম।Bangla Story
নিজের পছন্দ মতে ঘর সাজাতে শুরু করি, সংসার শুরু করি। কয়েকদিনে বুঝে গেলাম লোকটা কালো হলেও মনটা ছিলো সাদা ঝকঝকে। হাস্যজ্জ্বল একজন সাদামাটা মানুষ। সে আমার থেকে কিছুটা লম্বা ছিলো। কিন্তু মাঝে মাঝে আপসোস করতাম যদি সে আরেকটু লম্বা হতো।Bangla Story
একদিন রাতে মন খারাপ করে বারান্দায় বসে ছিলাম। সে অফিস থেকে এসে হাতমুখ ধুয়ে আমার পাশে এসে বসলো। শুধু জিজ্ঞেস করলো, "মন খারাপ তোমার?" উত্তরে আমি ছলছল চোখে তার দিকে তাকালাম। যতই তাকে মেনে নিতে চাই ততই কঠিন হচ্ছে দিনগুলো আমার জন্য। বান্ধুবিরা প্রায় ফোন দিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। আজও এমনই হলো। তাই আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। কেঁদেই ফেললাম। সেদিন রাতে বুঝেছি আমার কালো বেটে স্বামীটা হাসাতে পারে খুব। সেদিন হাসতে হাসতে আমি পেট চেপে ধরে তার গায়ে লুটিয়ে পড়ি।
এরপর সব স্বাভাবিকই চলতে থাকে। এতদিনে বুঝলাম সে যথেষ্ট আল্লাহভীরু। তখন মনটায় একটু ভালো লাগা কাজ করলো। রোজ রাতে ঘুমোতে যাবার এক ঘন্টা আগে সে আমাকে তার কোলে শুইয়ে দিয়ে ইসলামিক গল্প শুনাতো, নবীদের, জান্নাতি নারীদের জীবনী শুনাতো। মনটা তখন আনন্দের ঢেউয়ে মেতে উঠতো। দুজনে একসাথে তাহাজ্জুদ পড়তাম। সে ইমামতি করতো। তার কণ্ঠে তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হতাম।
আমাদের বিয়ের কবে যে দুইমাস কেটে গেলো সেটা বুঝতেই পারলাম না। সে এখন ছুটি পেলে বা অফিস থেকে যেদিন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে সেদিন আমাকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াবে। আবার সে লম্বা ছুটি পেলেই আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে যায়। এই কদিন আগেই আমরা বান্দরবান ঘুড়ে আসলাম। এতো খুশি লাগছিলো আমার। খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরি সেদিন। সেও তার হাতের বাঁধন খুব শক্ত করে রেখেছিলো।
একদিন তাকে জানালাম আমার সাজেক মেঘের দেশে যাবার ইচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজার ইচ্ছে শাড়ি পড়ে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুজনে মিলে ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে। হেটে হেটে ঝালমুড়ি খাওয়ার ইচ্ছে... আরো কতশত ইচ্ছে যে তাকে বললাম সেটা আমার নিজেরও মনে নেই। সেদিন লক্ষ করলাম সে খুব মনোযোগ শ্রোতা। আমার ঠোঁটের হাসি এবং চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে এবং গভীর মনোযোগের সাথে আমার প্রতিটা কথা শুনেছে। এমন মনে হচ্ছিলো যেনো আমি কোনো ছোট বাচ্চাকে রুপকার রাজ্যের পরিদের গল্প বলছিলাম।
ইদানীং আমি খেয়াল করলাম তার সাথে ভালোমতো কথা বলতে না পারলে আমি খুব অস্থির হয়ে যাই। তার কোলে মাথা না রাখলে আমার মনে হতো আজ কিছু বাদ পরছে। আমি ধীরে ধীরে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছিলাম। এমনই একদিন আমার এক বান্ধুবি তিনা বাসায় এলো। অনেকক্ষণ গল্প করলাম। সেদিন তিনা যাওয়ার সময় আমার হাত ধরে বললো, "তুই এটা কি বিয়ে করলি? একদম কালো গোয়ারের মতো। তুই এতো সুন্দর মেয়ে হয়ে এই রকম কালো খেতকে কিভাবে বিয়ে করলি? আমি হলে জীবনেও বিয়ে করতাম না।" তিনার মোবাইলে একজন সুদর্শন যুবকের ছবি দেখিয়ে বললো, "এটা আমার হাজবেন্ড। দেখেছিস কতটা স্মার্ট। এমন একজনকে কিভাবে বেছে নিলি? ছেলের অভাব পরেছিলো?"
টিটকারি, খোঁচা মেরে কথাগুলো বলেই বিদায় নিলো তিনা। আমি হতাশ হয়ে পরলাম। দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরেই দেখলাম আমার স্বামী রিমন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে সেদিন প্রথম পানি টলমল করতে দেখলাম। বুকটা সেদিন নিজের অজান্তেই ছ্যাত করে উঠলো। মনে হলো আমি এভারেস্ট এর উপর থেকে আছাড় খেয়ে পরেছি। এতোটা কষ্ট আগে কোনোদিন হয়নি আমার। ভালবাসার বাংলা গল্প
বিয়ের প্রায় আটমাস। এখন আমরা খুব স্বাচ্ছন্দেই বেঁচে আছি। একদিন বললাম, "আপনার তো বাইক আছে। আমাকে একদিন রাতের শহর ঘুড়ে দেখাবেন?" সে কাছে টেনে এনে বুকের সাথে মিশিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললো, "তোমার জন্য আমার জানটাও হাজির জানেমান।" সেদিন মুচকি হাসলাম। আজ সে আমাকে নিয়ে রাত এগারোটার পর বের হয়েছে এই রাতের শহর ঘুড়ে দেখাতে। একটা ভ্যান দোকানের সামনে গাড়ি থামালো সে। রাত তখন একটা। একজন ষাটার্ধ্বো মহিলা রিমনকে দেখে বললো, "বাবা তোমার আর মামনির অপেক্কা করতাচিলাম।" রিমন হেসে বললো, "ফুচকা বানানো শুরু করুন।" আমি অবাক হয়েছি। এই ইচ্ছেটা এভাবে পূরণ হবে আমি ভাবিনি। কারণ দিনের বেলা নেকাব খুলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার পক্ষে ফুচকা খাওয়া সম্ভব ছিলো না। কারণ আমি বেগানা পুরুষের সামনে আসতে চাইনি। রিমনও চায়না। এভাবে সে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে ভাবিনি। যদিও এই সারপ্রাইজ ছিলো সামান্য। তবে আমার কাছে এই সারপ্রাইজ থেকে দামি দামি সারপ্রাইজগুলো ফিঁকে মনে হলো। সেদিন বাসায় ফিরলাম রাত তিনটায়। দুজনে রুমে এসে শুয়ে পরলাম। চোখাচোখি হতেই খিলখিল করে হেসে দিলাম দুজনে। ভালবাসার বাংলা গল্প
তিন বছর গেলো আমাদের বিবাহিত জীবনের। কোনোদিন খুব বেশি রাগারাগি হয়নি। আমি রাগলে সে সবসময় চুপ করে থাকতো। রাগ কমলে আমাকে ক্ষেপিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো। আর আমি লজ্জায় তার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলতাম। তাকে অবশ্য কোনোদিন খুব একটা রাগ করতে দেইনি আমি। ভালবাসার বাংলা গল্প
একদিন সে আমাকে কানে কানে বললো, "ভালোবাসি প্রিয়তমা। তোমার স্বপ্নে না দেখা এই রাজ্যহীন প্রেমিক পুরুষের কি কোনোদিন ভাগ্য হবে তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শুনার?" আমি জবাবে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলাম। লজ্জা যেনো আড়ষ্ট করে ফেলেছিলো আমাকে। রিমন সেদিন আমার লজ্জায় লাল হওয়া নাকের ডগায় টুপ করে ঠোঁট ছুয়ে দিলো।
আমার হেটে ঝালমুড়ি খাওয়ার স্বপ্নটা পুরণ করার জন্য আজ আমরা ঢাকার কাশবন এসেছি। এদিকে মানুষজন কম থাকে বিধায় এদিকে নিয়ে এসেছে। ঝালমুড়ি আসার সময় কিনে এনেছি। যদিও সেগুলো আর মচমচে নেই। তাতে কি? ইচ্ছে তো পূরণ হচ্ছে। আমি নেকাব খুলে ফেললাম। দুজনে পাশাপাশি হেটে ঝালমুড়ি খাচ্ছি আর কাশফুল দেখছিলাম। তখন সামনে তিনা পরলো। রিমন অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তিনা অবাক হয়ে বললো, "তোরা এখনো একসাথে আছি?" আমি মুচকি হেসে বললাম, "হ্যাঁ। তোর খবর কি?" তিনা মুখটা কালো করে বললো, "খুব বেশি সুদর্শন ছিলো বিধায় আমাকে এতো বেশি পাত্তা দেয়নি সে। কারণ সে ডাকলেই মেয়েরা এমনিতেই সাড়া দেয়। আমি শুধুই অপশনাল ছিলাম তার কাছে। আমার কোনো ইচ্ছেই তার কাছে ভালো লাগতো না। আমার কোনো ইচ্ছেই কোনোদিন পূরণ করেনি। সেটা বাদ দিলাম। কোনোদিন স্ত্রীর মর্যাদাটাও দেয়নি। এখন বুঝি সংসার জীবনে সৌন্দর্যটা প্লাস্টিকের মতো। আসল সুদর্শন পুরুষ তো তারা যারা স্ত্রীর কাছে সুদর্শন।" তিনা চলে গেলো। আমি কিছু না বলেই রিমনের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। আজ আমার ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। কারণ আমার স্বামী সত্তিকারের সুদর্শন যুবক। রিমন শুধু মুচকি হাসছিলো।
সংসার জীবনে সৌন্দর্য আসলেই প্লাস্টিকের মতো। তাইতো বিশ্বসুন্দরী বা মিসওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স হয়েও নিজের বিবাহিত জীবন সুন্দর করে ধরে রাখতে পারে না। সিনেমার নায়কেরা এত সুদর্শন, ডেসিং হয়েও তাদের বিবাহিত জীবন সিনেমার মতো সুন্দর হয়না। "বাহ্যিক সৌন্দর্য শুধু চোখ জুড়ায় মন জুড়ায় না।" ভালবাসার বাংলা গল্প
আজ বারো বছর হয়ে গেলো আমাদের বিয়ের। এখনো একসাথেই আছি। মুষলধারে বৃষ্টি নামলো কিছুক্ষণ আগে। দুই বছরের মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে রুমে আসতেই রিমন একটা সূতির শাড়ি আমাকে দিয়ে বললো, "তাড়াতাড়ি করে পরে নাও। বৃষ্টি চলে যেতেও পারে।" আমি তাড়াতাড়ি করে পরে নিলাম। দুজনে একসাথে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছি। এরই মাঝে কাক ভেজা হয়ে গেলাম। রিমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো আর আমি বৃষ্টির পানির মধ্যে ছোটাছুটি করছিলাম। রিমন হাত ধরে টেনে কাছে নিলো আমাকে। কপালের মাঝে গভীরভাবে ঠোঁট ছোয়ালো। রিমনের গলা জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বললাম, ভালবাসার বাংলা গল্প
-- "ভালোবাসি আমার প্রিয়তম।" ভালবাসার বাংলা গল্প
সেদিন তার হাতের বাঁধনের নিচে চাপা পরে আমি ভর্তা হয়েছি। একদিন হুট করেই এসে বললো, "প্রিয়তা রেডি হও আমরা সাজেক যাবো।" মেয়েকে নিয়ে এই প্রথম ট্যুরে গিয়েছি। সেদিন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দাম্পত্য মনে হয়েছিলো। যারা যারা এসেছিলো সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো। রিমন মেয়ের সাথে দৌড় খেলা খেলছে। আর আমি তাদের দুজনকে বসে বসে দেখছিলাম। জীবনটা আসলেই অদ্ভুত। আমরা সুন্দর মানুষকে দেখলে ভাবি তার মনটা একদম তার মতোই সুন্দর আর কালো মানুষকে অবজ্ঞা করি। অথচ কিছু কিছু সুন্দর মানুষের মন কালো রঙের হয়। আর কালো মানুষের মন হয় সাদা ফকফকা। যেমন আমরা দুজন।Bangla Story
ত্রিশটা বসন্ত একসাথে পার করেছি দুজনে। এখনো মাঝরাতে মুষলধারে বৃষ্টি নামলে সে আমাকে নিয়ে ছাদে চলে আসে। শীত আসবে আসবে এমন সময় এলেই আমাকে নিয়ে কাশবন ছুটে যাবে একসাথে হেটে ঝালমুড়ি খেতে। রাতের আঁধারে বেরিয়ে পরে ফুচকা খেতে।Bangla Story
সে শুয়ে ছিলো। চুল এবং দাড়ি কিছুটা সাদা হয়ে এসেছে। আমারও চুল অল্প অল্প সাদা হয়ে এসেছে। কাজ শেষ করে রুমে এসে তার পাশে শুয়ে কানে কানে বললাম, "ভালোবাসি আমার প্রিয়তম।"Bangla Story
লেখা- নাহার
Disqus Comments